রচনায়: মিকি পল গনসালভেছ, উন্নয়ন সমন্বয়কারী, চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস
ঘোষিত হলো নতুন আর্চবিশপের নাম- আনন্দ বার্তায় উদ্বেলিত চট্টগ্রামের মেষপাল: করোনা আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু, বহু প্রিয়জন! আর্চবিশপ মজেস কস্তা, সিএসসি’র আকস্মিক মৃত্যুতে চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস হয়ে পড়েছে স্তব্ধ! তারপর ৩৩,০০০ খ্রিস্টভক্তের দীর্ঘ প্রতীক্ষা নতুন পালকের অপেক্ষায়! আটমাস মেষপালক বিহীন হয়ে থাকা খ্রিস্টভক্তদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের নতুন মেট্রোপলিটান আর্চবিশপের নাম ঘোষণা করেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি ও ভাটিকান রাষ্ট্রদূত মহামান্য আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী ভাটিকানের সাথে একযোগে চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পবিত্র জপমালা রাণী ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লী থেকে উক্ত ঘোষণা পাঠ করেন বিকাল ৫.০০ ঘটিকায়। নতুন আর্চবিশপ হিসেবে পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএিসসি’র নাম ঘোষিত হওয়ার পর চট্টগ্রামের খ্রিস্টভক্তগণ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এ’যে তাদের বহু চেনা পালক, হৃদয়ের একান্ত কাছের মানুষ! আনন্দধারা বহিছে ভুবনে… শুরু হয় নতুন আর্চবিশপকে আর্চডাইয়োসিসে বরণের বিস্তারিত ও ব্যাপক প্রস্তুতি।

করোনা ছোবলে আনন্দ আয়োজন: অধিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় কমিটি, নির্বাহী কমিটি, সমন্বয় কমিটি এবং আরো ১২টি উপ-কমিটি! বহু সংখ্যক খ্রিস্টভক্তের উপস্থিতিতে সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠান আয়োজনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। সভার পর সভা, রিহার্সালের পর রিহার্সাল। খ্রিস্টভক্ত, বিশেষভাবে শিশুদের সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে আর্চবিশপ ভবন আর ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর আঙ্গিনা। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সবকিছু ভেস্তে যায়। ছোট থেকে আরো ছোট হতে থাকে আয়োজন, শেষ পর্যন্ত স্থগিত করতে হয়, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আর্চবিশপের আগমনের দিনক্ষণ। করোনার উর্ধ্বগতিতে লকডাউন এর সময় বাড়তে থাকে এবং সেই সাথে বাড়তে থাকে অনাকাঙ্খিত প্রতীক্ষার প্রহর।

অনিশ্চয়তার যবনিকাপাত, নবনিযুক্ত আর্চবিশপের আগমন: অবশেষে শেষ হলো ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন গণনা। অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে করোনাকালীন বিধিনিষেধ এর মধ্যেই আর্চবিশপের আগমনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ এবং নানা আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত জনগণের অনুপস্থিতিতে অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্যে আর্চবিশপকে বরণের জন্য প্রস্তুত হয় চট্টগ্রাম। ২১ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ রোজ শুক্রবার বিকাল ০৫ ঘটিকায় আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি পাথরঘাটাস্থ জপমালা রাণীর ক্যাথিড্রাল গির্জা প্রাঙ্গনে পদার্পন করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি মহামান্য আর্চবিশপ জর্জ কোচেরি এবং ঢাকা আর্চডাইয়োসিসের মেট্রোপলিটান আর্চবিশপ পরম শ্রদ্ধেয় বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই। অন্তর্বতীকালীন সময়ে চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা ফাঃ লেনার্ড সিঃ রিবেরু এবং অভ্যর্থনা ও যোগাযোগ উপ-কমিটি তাদেরকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। স্থানীয় কৃষ্টিতে আর্চবিশপকে বরণ করার জন্য আর্চবিশপ হাউজ প্রাঙ্গনে তখন প্রস্তুত অভ্যর্থনা দল এবং অনলাইনে সম্প্রচারের জন্য মিডিয়া টিম। যুবদের আঁকা আলপনার কেন্দ্রবিন্দুতে নির্ধারিত আসন গ্রহণ করেন পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি।

এসো এসো আমার ঘরে এসো… স্থানীয় কৃষ্টিতে মেষপালককে বরণ: দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষিত নতুন ধর্মগুরু আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি‘কে পেয়ে, গুরুভক্তির চিহ্ন হিসেবে পরম শ্রদ্ধায় তার পদযুগল ধুয়ে দেন দু’জন খ্রিস্টভক্ত। আর্চবিশপের মঙ্গল কামনায় তার কপালে লেপন করা হয় চন্দন তিলক। চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের মেষপালের সাথে মেষপালক হিসেবে তার পবিত্র সম্পর্কের সূচনার চিহ্নস্বরূপ হাতে পড়িয়ে দেয়া হয় রাঁখি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাসহ সকল কৃষ্টির খ্রিস্টভক্তগণের পক্ষে একজন খ্রিস্টভক্ত আর্চবিশপ মহোদয়কে আদিবাসী উত্তরীয় রিশা পড়িয়ে সম্মান জানান। চট্টগ্রামে বসবাসরত অসংখ্য গারো অভিবাসীর পক্ষে তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক খুথুব পরিয়ে দেন একজন গারো যাজক। পবিত্রতা ও ভালবাসার প্রতীক হিসেবে আর্চবিশপকে পুষ্পমাল্য দিয়ে বরণ করেন একজন খ্রিস্টভক্ত। পরিশেষে আর্চবিশপের প্রতি ভালাবাসা ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তাকে রুমাল প্রদান করেন একজন খ্রিস্টভক্ত। অতঃপর নবনিযুক্ত আর্চবিশপ ও উপস্থিত অন্যান্য বিশপগণ প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস কস্তা, সিএসসি ও সকল পূর্বসূরী বিশপগণের কবরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে প্রার্থনা করেন।

নবনিযুক্ত আর্চবিশপের মঙ্গল কামনায় পবিত্র সাক্রামেন্তের আরাধনা: বরণ অনুষ্ঠান শেষে দিনের আলো ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যখন গোধূলী, তখন উপস্থিত সকলে সমবেত হয়েছে পবিত্র জপমালা রাণী ক্যাথিড্রাল গির্জা অভ্যন্তরে পবিত্র সাক্রামেন্তের আরাধনায় অংশ নিতে। প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হাতে আর্চবিশপ সুব্রত ক্যাথিড্রালে প্রবেশ করলেন যেন নতুন দিশার দিশারী হয়ে। ধ্যানমগ্ন পরিবেশে, গানে ও প্রার্থনায় প্রভুর ধন্যবাদ ও প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে আরাধনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

ক্যাথিড্রাল অভিমুখে শোভাযাত্রা- একটি নতুন সকাল, নতুন যুগের সূচনা: পাখির কলরব, নতুন ভোরের নবারুন আলো, এক পশলা শান্তির বৃষ্টি… দিনটি হলো ২২ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। সকাল ০৮ ঘটিকা থেকেই ক্যাথিড্রালের বাইরে আগত অতিথিবৃন্দ অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম পেতে যাচ্ছে তার নতুন মেষপালক, সেই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত চারিদিক। সকাল ০৯ ঘটিকায় ক্যাথিড্রাল এর যাজক ভবনের সামনে থেকে শুরু হল শোভাযাত্রা। চট্টগ্রামের সকল ধর্মপল্লীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ডাইয়োসিস থেকে আগত যাজকগণের দীর্ঘ সারি, বাংলাদেশের সকল বিশপগণ ও একমাত্র কার্ডিনাল এবং সর্বশেষে আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি শোভাযাত্রা করে ক্যাথিড্রালের রুদ্ধ প্রবেশদ্বারের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।

ক্যাথিড্রালের বদ্ধ দ্বার হল উন্মুক্ত: চট্টগ্রাম এর নতুন মেষপালক ক্যাথিড্রালের দরজায় দাঁড়িয়ে করা নাড়লেন তিনবার। নীরব ক্যাথিড্রাল এর অভ্যন্তরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান যাজক, সন্ন্যাসব্রতী ও খ্রিস্টভক্তদের মধ্যে সেই শব্দ যেন আনন্দের ঘন্টাধ্বনির মত বেজে উঠলো। অপেক্ষমান মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি এবং ঢাকার আর্চবিশপ পরম শ্রদ্ধেয় বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করলেন ক্যাথিড্রালের প্রধান ফটক। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয়া সূযের উজ্জ্বল আলোক রশ্মি এসে পড়লো ক্যাথিড্রালের ভিতর। বাংলার প্রথম খ্রিস্টশহীদ ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্ণান্দেজ, এসজে এবং শত শত খ্রিস্টশহীদের রক্তস্নাত ক্যাথিড্রালে নতুন মেষপালক হিসেবে প্রথমবারের মত পদার্পন করলেন পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি। ক্রুশ হাতে সেবকদল এবং খ্রিস্টবাণী বয়ে আনা একজন যাজক এবং তার পরপরই পোপীয় অনুজ্ঞাপত্রটি সকলের দৃষ্টিগোচর করে শোভাযাত্রাটি বেদীমঞ্চে এসে উপস্থিত হল।

পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস প্রদত্ত আর্চবিশপ নিয়োগের অনুজ্ঞাপত্র পাঠ: বাণীমঞ্চে দাঁড়িয়ে নতুন আর্চবিশপকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত মেষপালকের অনুপস্থিতে চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকারী শ্রদ্ধেয় ফাঃ লেনার্ড সিঃ রিবেরু। মহান সৃষ্টিকর্তার গৌরব করে তিনি আরো একবার ঘোষণা করলেন যে অধিষ্ঠান খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলদার, সিএসসি চট্টগ্রামের সকল মেষদের আধ্যত্মিক যত্ন, ভালবাসাসিক্ত পালকীয় সেবা ও পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। পোপ ফ্রান্সিস প্রদত্ত যে অনুজ্ঞাপত্রের মাধ্যমে এই দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন, তা সকলের উদ্দেশ্যে প্রদর্শনপূর্বক পাঠ করে শোনানোর জন্য তিনি আহ্বান জানান চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের মন্ত্রণা পরিষদের সদস্য ফাঃ টেরেন্স রড্রিক্সকে। ফাঃ টেরেন্স রড্রিক্স ল্যাটিন ভাষায় লিখিত মূল অনুজ্ঞাপত্রটি উপস্থিত সকল বিশপ, যাজক এবং খ্রিস্টভকে প্রদর্শন করলেন। এরপর তিনি অনুজ্ঞাপত্রের ইংরেজি অনুবাদ এবং ফাঃ প্রণয় আন্তনী গমেজ, সিএসসি বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন।

শূণ্য ক্যাথেড্রা পূর্ণ হলো আবার: সেবাকারী নেতৃত্বের পালকীয় আসন হল ‘ক্যাথেড্রা’, যেটি ক্যাথিড্রাল গির্জা অভ্যন্তরে বিশপের জন্য সংরক্ষিত আসন। চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের ক্যাথেড্রাটিতে সর্বশেষ আসীন হয়েছিলেন স্বর্গীয় আর্চবিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসি। তার আকস্মিক প্রয়ানে চট্টগ্রামের মেষপালের হৃদয়ে যেমন শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো, তেমনি এই আসনটিও শূন্য ছিল দীর্ঘ ১০টি মাস। ঢাকার আর্চবিশপ পরম শ্রদ্ধেয় বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই এবং মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে যখন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি’কে সেই আসনে অধিষ্ঠিত করলেন, তখন আসনটি যেমন পূর্ণ হল তেমনি আনন্দে পরিপূর্ণ হল চট্টগ্রামের খ্রিস্টভক্তদের হৃদয়। আর্চবিশপ বিজয় চট্টগ্রামের নতুন আর্চবিশপকে পড়িয়ে দিলেন মাইটার (বিশপীয় টুপি), কার্ডিনাল প্যাট্রিক তার হাতে হস্তান্তর করলেন ক্রসিয়ার (বিশপীয় যষ্টি)। দুই গুরু ধর্মপাল তার দু’স্কন্ধে হাত রেখে কাথলিক মণ্ডলীর ভ্রাতৃত্ব ও একতার চিত্রই যেন ফুটিয়ে তুললেন অপূর্বভাবে। আর্চবিশপ বিজয় এন. ডি’ক্রুজের সামনে জানুপাত করে বিশ্বাসমন্ত্র উচ্চারণ করার পর সকলের সামনে এসে দাঁড়ালেন পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি। তিনি চট্টগ্রামের নতুন ধর্মপাল, নতুন মেষপালক! উপস্থিত ও অনলাইনে অংশগ্রহণকারী খ্রিস্টভক্তবৃন্দ প্রাণ ভরা শুভেচ্ছা জানালেন তাকে।

নবঅধিষ্ঠিত মেষপালকের প্রথম খ্রিস্টযাগ অর্পন: পুণ্যপিতার প্রতিনিধি মহামান্য আর্চবিশপ জর্জ কোচেরি, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর সকল বিশপ, ৩২ জন যাজক, ২৩ জন ব্রাদার ও সিস্টার এবং ৬৪ জন খ্রিস্টভক্ত স্বশরীরে প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থিতির মাধ্যমে সাক্ষী হয়েছিলেন চট্টগ্রাম ক্যাথিড্রালে অনুষ্ঠিত অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান ও আর্চবিশপ হিসেবে পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সিএসসি’র উৎসর্গীকৃত প্রথম খ্রিস্টযাগে। সহ-উৎসর্গকারী হিসেবে সাথে ছিলেন ঢাকার আর্চবিশপ এবং মহামান্য কার্ডিনাল মহোদয়। দেশব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমন না কমায় শুধুমাত্র প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে অধিষ্ঠান খ্রিস্টযাগটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টভক্ত ফেসবুক লাইভ মাধ্যমে অনলাইনে খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করেছেন।

অনাড়ম্বর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান: খ্রিস্টযাগ শেষে চট্টগ্রাম কাথলিক আর্চডাইয়োসিসে আর্চবিশপ পদে অধিষ্ঠান স্মরণে প্রকাশিত ১২৮ পৃষ্ঠার বিশেষ স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন নব অধিষ্ঠিত আর্চবিশপ। অতঃপর চট্টগ্রামের নবনিযুক্ত মেট্রোপলিটান আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি; সম্প্রতি দায়িত্বগ্রহণকারী ঢাকার মেট্রোপলিটান আর্চবিশপ বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই এবং সিলেটের মনোনীত বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজকে ফুলেল শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়। এ’সময় বক্তব্য রাখেন পুণ্যপিতা পোপের প্রতিনিধি ও ভাটিকান রাষ্ট্রদূত পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী। বক্তব্যে তিনি পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি’কে বরিশাল ডাইয়োসিসের প্রৈরিতিক প্রশাসক নিয়োগের ঘোষণাও দান করেন। আরো বক্তব্য রাখে ঢাকার আর্চবিশপ ও বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট পরম শ্রদ্ধেয় বিজয় এন. ডি’ক্রুজ, ওএমআই ও মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি। অনুভ‚তি ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন নবনিযুক্ত আর্চবিশপ পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি। প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসি’র অকস্মাৎ মৃত্যুর পর ১৫ জুলাই ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধর্মপ্রদেশীয় প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া শ্রদ্ধেয় ফাদার লেনার্ড সি. রিবেরূকে এ সময় খ্রিস্টভক্তগণের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। ফাদার লেনার্ড সি. রিবেরূর ধন্যবাদ বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয় অনাড়ম্বর অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান।

নতুন দিনের অপেক্ষায় পাল্লিউম বিভূষণ অনুষ্ঠান: স্বশরীরে অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না পারার যে অতৃপ্তি চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের খ্রিস্টভক্ত, সিস্টার, ব্রাদার ও যাজকগণের মধ্যে, তা বিবেচনায় রেখে মেট্রোপলিটান আর্চবিশপের পরিধেয় মেষের লোমে তৈরী উত্তরীয় পাল্লিউম বসন পরিধান স্থগিত রাখা হয়েছে এক নতুন দিনের অপেক্ষায়, যেদিন করোনার আগ্রাসী থাবা কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে আসবে। নবনিযুক্ত আর্চবিশপ পরম শ্রদ্ধেয় লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি জানান, অবস্থা বিবেচনা করে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত হবে মেট্রোপলিটান আর্চবিশপের পাল্লিউম বিভূষণ অনুষ্ঠান। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায় প্রতীক্ষার দিন গুনছি আবারো।

পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি’র অধিষ্ঠানকে ঘিরে বিভিন্ন জনের অনুভূতি, স্বপ্ন ও প্রত্যাশা
সংগ্রহে: মানিক উইলভার ডি’কস্তা
ফাদার লেনার্ড সি. রিবেরু
ভিকার জেনারেল, চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস

আর্চবিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসি’র আকস্মিক প্রয়ান মেনে নিতে কষ্ট হলেও তা চরম সত্য। পরমেশ্বর নিশ্চয়ই তাকে স্বর্গীয় পুরস্কার দান করেছেন। চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসে আর্চবিশপ মজেসের শূণ্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। বিশপবিহীন ১০ মাস সময় চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসকে পরিচালনার দায়িত্বভার আমার উপরে ন্যস্ত ছিল। এই সময়টুকু ঈশ্বরের আশীর্বাদ, যাজক ও সন্ন্যাসব্রতীদের সহযোগিতা, খ্রিস্টভক্তজনগণের প্রার্থনায় সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছে। ঈশ্বর ও সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
আর্চবিশপ সুব্রত আমাদের কাছে অজানা-অচেনা নয়, আবার চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসও আর্চবিশপ সুব্রত’র কাছে অজানা-অচেনা নয়। এটি হবে তার পালকীয় কাজের সবচাইতে বড় শক্তি। আমি মনে করি, আর্চবিশপ সুব্রত তার পালকীয় দায়িত্বে মেষপালকে আরো কাছে টানতে সক্ষম হবেন। তার পালকীয় নেতৃত্বে আমি যা প্রত্যাশা করি:
– বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মিত পালকীয় পরিদর্শন, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও খ্রিস্টভক্তদের জন্য বিশেষ ভাবনা ও সার্বিক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
– যাজক, সন্ন্যাসব্রতী ও খ্রিস্টভক্তদের একাত্মতায় বিশ্বাসের যাত্রায় মিলন সমাজ হয়ে ওঠার সাধনা।
– নতুন এলাকায়, যেমন: কক্সবাজার, ফেনী, চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, ফটিকছড়ি, রামগড় সহ অন্যান্য এলাকাগুলোতে খ্রিস্ট মণ্ডলীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
– যাজক ও সন্ন্যাসব্রতীয় জীবনে আহ্বান বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
– ভক্তজনগণ ও খ্রিস্টমণ্ডলীর পরিচালকদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন।
– ডাইয়োসিসের যুব কমিশন ও যুব কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত ও সক্রিয় করে তোলা।
– ডাইয়োসিসের বিদ্যমান ধারা চলমান রেখে প্রয়োজনীয় নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করা।
– প্রয়াত আর্চবিশপের অসমাপ্ত কাজগুলো, বিশেষভাবে তার স্বপ্ন ও দর্শন পূর্ণ করতে যথাসম্ভব চেষ্টা করা।
– স্থানীয় মণ্ডলী গঠন, ভক্তজনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, বিশ্বাসের গঠন ও চর্চা সক্রিয়করণ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ মনযোগ দান।
– আর্চডাইয়োসিসে কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর প্রজ্ঞাপূর্ণ সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
******
ব্রাদার সুব্রত লিও রোজারিও, সিএসসি
অধ্যক্ষ, সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল এণ্ড কলেজ ও
সমন্বয়কারী, চট্টগ্রাম মহাধর্মেপ্রদেশীয় শিক্ষা কমিশন

ধর্মপাল হলেন ডাইয়োসিসের অভিভাবক ও গুরু। মেষপালের কাছে তিনি আছেন যিশুরই স্থানে। আমি প্রত্যাশা ও বিশ্বাস করি, নবনিযুক্ত আর্চবিশপ সুব্রত যিশুর দেখানো পথেই তার জনগণকে শিক্ষার আলো দান করতে প্রয়াসী হবেন। তিনি শিক্ষা সেবা কাজকে এমনভাবে পরিচালনা দান করবেন যেন তারা চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসে:
– খ্রিস্টিয় মূল্যবোধের শিক্ষা ব্যাপকতা ও গভীরতা লাভ করে। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী যেন মানবিক মূল্যবোধে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
– ছাত্র-ছাত্রীরা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যিশু যেভাবে পরিচর্যা করেছেন, তেমনি পরিচর্যা পায়। তিনি যেভাবে মানুষের কাছে গিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন পাহাড়ে, হ্রদে, উন্মুক্ত স্থানে, প্রকৃতির কাছে গিয়ে- ঠিক একইভাবে মনোভাবে যেন আমাদের শিক্ষা সেবা কাজ পরিচালিত হয়।
– খ্রিস্ট ছিলেন সঠিক, নীতিবান শিক্ষক- তাই সততা ও ন্যায্যতার পক্ষে তিনি অবস্থান নিতে পেরেছেন বলিষ্ঠভাবে। আর্চডাইয়োসিস শিক্ষা সেবা কাজে সংশ্লিষ্ট সকলকে সৎ ও নীতিবান হয়ে উঠতে অনুপ্রেরণা ও গঠন দান করবে।
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন পরিবেশ লালন করবে, যেন শিশুরা প্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষকদের কাছে আসার গভীর ইচ্ছা লালন করে। কারণ যিশু বলেছেন, ‘শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও’।
– প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস বলতেন, ছাত্রদের পরিবেশ রক্ষার শিক্ষা দিতে হবে, প্রকৃতিকে ভালবাসার কথা বলতে হবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গঠন করতে হবে। এই বিষয়গুলো যেন আমাদের শিক্ষা সেবা কাজে চলমান থাকে।
******
সিস্টার এলিজাবেথ ত্রিপুরা
এলএইচসি সংঘের সিস্টার

এলএইচসি সংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় সন্ন্যাস সংঘরূপে। পরে বরিশাল ডাইয়োসিস প্রতিষ্ঠা হলে সংঘটি বরিশালের স্থানীয় সন্ন্যাস সংঘ হিসেবে রূপান্তরিত হয়। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্তান, এলএইচসি সংঘের একজন সিস্টার। সেই সুবাদে বরিশালের বিশপ হিসেবে দীর্ঘ সময় আর্চবিশপ সুব্রত’কে কাছে থেকে দেখেছি। বিভিন্ন সময় তার সাথে আলাপচারিতায় আমি বুঝতে পারি যে চট্টগ্রামের সহকারী বিশপ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তার ভাল অভিজ্ঞতা আছে। তিনি তাদের কাছে গিয়েছেন, তাদের সাথে মিশেছেন ও তাদের জীবনকে গভীরভাবে বোঝেন। এই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্য নিংসন্দেহে আশীর্বাদ। আমি বিশ্বাস করি, তিনি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের খুব কাছাকাছি যেতে পারবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন বিশপ হিসেবে প্রচুর পালকীয় পরিদর্শন প্রয়োজন। আর্চবিশপ সুব্রত বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন হওয়ায় সফরগুলো দূর্গম হলেও তার পক্ষে করা সম্ভব, আগেও সহকারী বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার মাছে সেই তাড়না দেখেছি। তিনি সঠিক সময়ে ঈশ্বরের যোগ্য ব্যক্তি, তাই তাকে বেছে নিয়েছেন। আদিবাসীদের একজন হিসেবে আমি উপলব্ধি করি, পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টভক্তগণ বিশ্বাসের জীবনে এখনো নবীন, আহ্বান জীবনেও তেমন কেউ নেই। এই দুটো বিষয়ে আর্চবিশপ মহোদয় বিশেষ দৃষ্টি দেবেন বলে আমার প্রত্যাশা। আদিবাসী পরিবারগুলোর কাছে যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতীয় আহ্বান এখনো পরিষ্কার নয়। এই জীবন সম্পর্কে তাদের ও যুবদের সচেতন করার জন্য বিশেষ পালকীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিষয়টি নতুন আর্চবিশপ বিবেচনা করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
******
যোয়াকিম মান্না বালা
ধর্মপ্রদেশীয় সেক্রেটারি, বরিশাল ডাইয়োসিস

বরিশাল ডাইওসিস বয়সে নবীন। পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি’র নেতৃত্ব ও পরিচালনায় ডাইয়োসিস বেড়ে উঠছিল ছোট একটি চারা গাছেরই মত। অতি অল্প সময়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডাইয়োসিসের বিশ্বাসী জনগনের পালকীয় যত্ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বহুমাত্রিক কাজে ভক্তগনগনের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে বরিশাল ডাইয়োসিস থেকে বিশপ মহোদয়ের বিদায় কিছুটা যে প্রভাব ফেলবে না তা বলার অবকাশ নেই। তথাপি, যোগ্য পালকরূপে চট্টগ্রাম ডাইয়োসিসে সহকারী বিশপরূপে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং বরিশাল ডাইয়োসিসের প্রথম বিশপরূপে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আর্চবিশপ মহোদয়ের গুনাবলীসমূহ চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের অগ্রাধিকারগুলোকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে বলে মনে করছি।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে আমাদের বিশপ মহোদয়ের চট্টগ্রামের আর্চবিশপ নিয়োগের সংবাদ শোনার পর থেকে এ’যাবত কেমন যেন একটা শূণ্যতা বোধ হচ্ছিল। তবে ২২ মে তারিখে যখন জানলাম, নতুন বিশপ নিয়োগ ও তিনি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত আর্চবিশপ সুব্রতই বরিশালের প্রৈরিতিক প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন, অনেকটা স্বস্তি কাজ করেছে। এতে করে নবগঠিত বরিশাল ডাইয়োসিসের বেড়ে ওঠার যে গতি, তা চলমান থাকবে। চট্টগ্রাম হতেই বরিশাল ডাইয়োসিস সৃষ্ট হওয়ায় শুরু থেকেই দু’টি ডাইয়োসিসের মধ্যে আন্তরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বিদ্যমান আছে। বর্তমান অবস্থায় তা আরো সমৃদ্ধ হবে বলে আমি আশা করছি।
******
বাবরা গোমেজ
শিশু এনিমেটর, অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী

পরিবারে কর্তা না থাকলে কেমন যেন দিশেহারা লাগে। আর্চবিশপ মজেসের প্রয়ানের পর আমাদের মণ্ডলীর পরিবারেও দিশেহারা বোধ হতো- কেমন যেন একটা শূণ্যতা, সব থেকেও কি যেন নেই, অভিভাবক শূণ্যতা! ১০টি মাস ধরে খ্রিস্টযাগে আসলে কখনোই দেখতাম না আর্চবিশপ মজেসের হাসি মাখা মুখ- কেমন যেন একটা গভীর নিস্তব্ধতা ক্যাথিড্রাল জুড়ে।
নতুন আর্চবিশপ মনোনয়নের দিন শীতলপুরে ছিলাম। ফিরে এসে যখন শুনলাম- পরিচিত নাম শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে, স্বস্তির একটা পরশ অনুভব করেছি। তারপর অধিষ্ঠান নিয়ে হলো কতনা পরিকল্পনা, কতনা মানুষ কত দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রস্তুতি নিতে লাগলো। করোনার থাবায় দুইবার অনুষ্ঠানটি সংকুচিত করা হলো, পরে স্থগিত হয়ে গেল! ২২ মে তাকে পেলাম আমাদের মাঝে ১০০ জনের কিছু বেশী খ্রিস্টভক্তের উপস্থিতিতে। প্রস্তুতির কিছুই কাজে লাগলো না। তবু, ঘরের কর্তা ঘরে এসেছেন, সেটাই আনন্দ। সীমিত হলেও অনুষ্ঠানটি সুন্দর ছিল।
আমি আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদারের বিশপীয় দায়িত্ব পালনকালে যা প্রত্যাশা করছি:
– তিনি প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস কস্তা, সিএসসির অসমাপ্ত কাজগুলো চলমান রাখবেন।
– প্রয়াত আর্চবিশপ ডাইয়োসিসের ইতিহাস, বিভিন্ন সময়ে পুণ্য পিতার শিক্ষা, ধর্মপালের শিক্ষা, ইত্যাদি দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে শিক্ষা আসর আয়োজন করতেন। তিনি প্রতি বছর ডাইয়োসিসের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে একেকবার একেক ধরণের খ্রিস্টভক্তদের সাথে মতবিনিময় করতেন, একেক বছর একেকটি বিশেষ বিষয়ে শিক্ষা ও আলোচনা করতেন। এই বিষয়গুলো যেন চলমান থাকে, সেটি আমার প্রত্যাশা।
– মণ্ডলী কারা পরিচালনা করছেন, কিভাবে করছেন, অর্থের সংস্থান কিভাবে হচ্ছে, খ্রিস্টভক্তগণ কতটুকু অংশগ্রহণ করছেন- এই তথ্যগুলো স্বচ্ছতার সাথে প্রয়াত আর্চবিশপ সকল খ্রিস্টভক্তের সাথে সহভাগিতা করতেন। তার সময়ে অর্থনৈতিক খ্রিস্টভক্তদের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করি নতুন আর্চবিশপ এই অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে সক্ষম হবেন।
– খ্রিস্টভক্তদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে প্রয়াত আর্চবিশপ অনেক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করেছেন, বিভিন্ন ধরণের সংগঠন/ এসোসিয়েশন/ মুভমেন্টের সাথে বসেছেন, আলোচনা করেছেন। বিশেষভাবে স্থানীয় ও নিজস্ব মডেলে ক্ষুদ্র খ্রিস্টিয় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি যথেষ্ট সফল ছিলেন। আর্চবিশপ সুব্রত বিষয়গুলোর প্রতি জোড় দেবেন বলে আমি আশা করছি।
******
জুড ফ্লেবিয়ান বালা
সেক্রেটারি, পালকীয় সেবা দল এবং সহ যুব সমন্বয়কারী, চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস

চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসের পালকীয় সেবা দলে আমি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে কর্মরত আছি। পালকীয় কাজ এবং যুবদের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসি’র নিয়মিত সান্নিধ্য পেয়েছি। কার্যালয়ে তিনি ছিলেন সদাহাস্যময়, তার উপস্থিতি ছিল নীরব কিন্তু সবল। তার অকাল প্রয়ানে সম্পূর্ণ ডাইয়োসিসের মত আর্চডাইয়োসিসান কার্যালয়ও হয়ে পড়েছিল নিস্তব্ধ।
দীর্ঘ ১০ মাস পর চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিসে আর্চবিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার, সিএসসি। আমি খুবিই আনন্দিত তাকে আমাদের মাঝে পেয়ে। যুব হিসেবে তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি বহু আগেই, এবার তার কর্মী হিসেবে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেলাম। আশা করছি তার পালকীয় নির্দেশনায় ডাইয়োসিসের পালকীয় সেবা কাজে আমি আরো সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হবো।
******
ক্যালভিন গোনসালভেছ
অধিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকদলের আহ্বায়ক ও প্রাক্তন সভাপতি, খ্রিস্টিয়ান স্টুডেন্টস্ অর্গানাইজেশন (সিএসও)

অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানের মত বড় একটি কর্মসূচীতে স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া আমার জন্য প্রথম। তাই অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনেক উত্তেজনা আর প্রত্যাশা ছিল। সভার পর সভায় অংশগ্রহণ করি, প্রস্তুতি নেই। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে আয়োজন সীমিত সীমিত সব কিছুই স্থগিত হয়ে গেল। নতুন তারিখে একেবারেই সীমিত আয়োজন। তেমন একটা কিছু করার ছিলনা, এমনকি স্বেচ্ছাসেবক দলের কেউ থাকারও সুযোগ পায়নি। প্রতি উপ-কমিটি’র আহ্বায়ক ও সহ আহ্বায়ক আমন্ত্রিত হওয়ায় সুযোগ পেয়েছি অংশগ্রহণের।
নতুন আর্চবিশপকে পেয়ে মনে হচ্ছিল, মাথার উপরে আবারো ছায়া এসেছে আমাদের। আমি একজন যুব। আর্চবিশপ মহোদয় দীর্ঘদিন যুব কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অধিকারের জায়গা থেকে আমার কিছু প্রত্যাশা আছে তার কাছে। জানিনা ঠিক কি না, তবে আমার মনে হচ্ছে যুগের পরিবর্তনে ও উপযুক্ত চ্যাপলেইন্সির অভাবে আমাদের ক্যাথিড্রাল প্যারিসে যুবদের আনাগোনা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যুবদের জন্য ডাইয়োসিসের বিশেষ কোন পালকীয় নীতিমালা আছে কি না বা এমন কিছু থাকার কথা কিনা আমি জানিনা। কিন্তু মনে হচ্ছে এমন একটা কিছু থাকলে ভাল হয়। যেখানে নির্ধারিত থাকবে প্রতি ধর্মপল্লীর যুব কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি, ধর্মপল্লীর যুবদের জন্য কোন ব্যক্তি চ্যাপলেইন্সি করবেন, কিভাবে যুবদের অংশগ্রহণ বাড়ানো হবে, কিভাবে তাদের চলমান গঠন দান করা হবে, ইত্যাদি। আর্চবিশপ সুব্রতর ব্যক্তিত্ব যুবদের কাছে টানতে সক্ষম। আমি বিশ^াস করি, তার নেতৃত্বে ডাইয়োসিসে যুব সেবা কাজে রাতারাতি একটা পরিবর্তন আসবে।
******