ধর্মশিক্ষা- ৩: “শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও।” (মথি ১৯:১৪) [এপ্রিল- মে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ]
একদিন কয়েকজন মা যীশুর কাছে তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে আসেন, যেন যীশু তাদের আশীর্বাদ করেন। শিষ্যেরা তাদের যীশুর কাছে যেতে বাঁধা দিলে যীশু তাদের বলেন, “শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও, বাঁধা দিও না।” (লুক ২: ৫২) যীশুর এই কথায় শিশুদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশিত হয়। তিনি চান যেন শিশুরা পরিবারে ও সমাজে সঠিক ভাবে বড় হয়ে ওঠে।
বিবাহ সাক্রামেন্তে স্বামী ও স্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেন যে, তারা তাদের সন্তানদের ঈশ্বরেরই দান বলে গ্রহণ করবেন ও তাদের খ্রিস্টিয় শিক্ষা বড় করে তুলবেন। “শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও”, একথার মাধ্যমে যীশু বোঝাতে চান, যেভাবে তিনি নিজে বড় হয়েছেন, প্রত্যেক শিশু যেন সেভাবেই বড় হয়।
লুক ২ অধ্যায়ে যীশুর শিশুকালের একটি ঘটনার মাধ্যমে আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আমরা পাই। বারো বছর বয়সে যীশু জেরুশালেমে নিস্তার পর্ব পালন করতে গিয়ে হারিয়ে যান। পরে “যীশু পিতামাতার সঙ্গে রওনা হয়ে নাজারেথে চলে গেলেন ও তাদের বাধ্য হয়ে থাকলেন। … এবং যীশু জ্ঞানে ও বয়সে, এবং ঈশ্বর ও মানুষের অনুগ্রহে বেড়ে উঠতে লাগলেন।” (লুক ২: ৫১-৫২) সকল শিশু যেন যীশুর মত জ্ঞানে ও বয়সে, ঈশ্বর ও মানুষের অনুগ্রহে (আনুকূল্যে) বড় হয়ে ওঠে এখানে আমরা সেই নির্দেশনা পাই।
ক) জ্ঞানে বৃদ্ধি লাভ করা
জ্ঞান অর্থ হলো যা কিছু সঠিক বা সত্য তা অভিজ্ঞতার আলোকে বেছে নেয়ার ও তা কাজে পরিণত করার সক্ষমতা। এই জ্ঞান মাত্র ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে। প্রবচন গ্রন্থে বলা হয়, “কেননা প্রভুই প্রজ্ঞা দান করেন, তাঁরই মুখ থেকে সদ্ জ্ঞান ও সুবুদ্ধি নিঃসৃত হয়।” (প্রবচন ২: ৬) বিভিন্ন উপায়ে ঈশ্বর আমাদের জ্ঞান দান করেন।
পবিত্র বাইবেল হলো ঈশ্বরের বাণী। এই ঈশ্বরের বাণী পাঠ ও ধ্যানের মাধ্যমে আমরা এক অবিশ্বাস্য জ্ঞান অর্জন করতে পারি। বাইবেলের মাধ্যমে আমরা সরাসরি ঈশ্বরের চিন্তা-ভাবনায় প্রবেশ করি। তবে আমরা সর্বোত্তম জ্ঞান লাভ করেছি, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের জন্য ঠিক নয়। প্রতিদিনই জ্ঞান লাভের জন্য আমাদের হৃদয় ও মনের দরজা উন্মুক্ত রাখা দরকার। সাধু যাকোব পরামর্শ রাখেন, তোমরা ঈশ্বরের কাছে জ্ঞান যাচ্ঞা করো, “তোমাদের যদি কারও প্রজ্ঞার অভাব থাকে, তবে সে ঈশ্বরের কাছে যাচ্ঞা করুক, যিনি সকলকে উদারভাবে ও তিরস্কার না করেই দান করেন; আর তাকে তা দেওয়া হবে।” (যাকোব ১:৫) যিনি আমাদের অন্তরে বাস করেন সেই পবিত্র আত্মার উপস্থিতিতে ঈশ্বর দান করেন জ্ঞান।
ঈশ্বর আমাদের বিভিন্ন ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করেন। আর সেই ঘটনা বা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের জ্ঞান দান করেন। কোন কোন সময় আমরা কিছু কিছু কষ্টের অভিজ্ঞতা বুঝতে পারি না, কিন্তু ঈশ্বর তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে আমাদের গঠন করেন। সাধু পৌল বলেন, “এজন্যই খ্রিস্টের খাতিরে আমি সমস্ত দুর্বলতা, অপমান, দুর্গতি, নির্যাতন ও সঙ্কটের মধ্যে তৃপ্তিই পাই, কেননা যখন আমি দুর্বল, তখনই আমি সবল।” (২ করি ১২: ১০)
খ) বয়সে বড় হওয়া
বয়সে বড় হওয়ার অর্থ হল সামাজিক পরিপক্কতা অর্জন করা। যীশুকে অনুসরণ করতে চাইলে আমাদের পরিপক্ক বা সাবালক হতে হবে। সাধু পৌল বলেন, “আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন শিশুর মত কথা বলতাম, শিশুর মত চিন্তা করতাম, শিশুর মত বিচার করতাম,; এখন যে মানুষ হয়েছি, শিশুর সেই সবকিছু বাদ দিয়ে দিয়েছি।” (১ করি ১৩:১১) জেরুশালেমের মন্দিরে যীশু তার কথাবার্তা ও আচরণের মাধ্যমে পিতামাতাকে দেখালেন যে তিনি আর অন্তরে শিশু নন। বাপ্তিস্মের পর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের পরিপক্ক হতে শুরু করতে হবে। সাধু পৌল এফিসিয়দের কাছে পত্রে সুস্পষ্টভাবে এই বিষয় ব্যক্ত করে বলেন, “যতক্ষণ না আমরা ঈশ্বরপুত্র-সম্পর্কিত বিশ্বাস ও জ্ঞানের ঐক্যে পৌঁছে খ্রিস্টের পরিপূর্ণতার পূর্ণমাত্রা অনুযায়ী সিদ্ধপুরুষ হয়ে উঠি, যেন আমরা আর শিশু না থাকি, এবং মানুষের চতুরতা এবং কুটিল ও ভ্রান্তিজনক ছলনার হাতে পড়ে আমরা যেন তরঙ্গমালার আঘাতে আলোড়িত না হই ও যেন যে কোন মতবাদের বায়ুতে এদিক ওদিক চালিত না হই… বরং ভালবাসায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে বৃদ্ধিলাভ করি।” (ইফি ৪: ১১-১৫)
গ) ঈশ্বরের অনুগ্রহে (আনুকুল্যে) বড় হওয়া
ঈশ্বর আমাদের দয়া করেন যখন আমরা আমাদের কৃত পাপ-অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে ফিরে যাই। তিনি আমাদের পাওনা সমস্ত শাস্তি থেকে মুক্ত করেন। আমাদের জন্য ঈশ্বরের কত মহৎ দয়া! এই দয়া লাভের জন্য আমাদের প্রতি ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য থাকতে হবে আর তাঁর আজ্ঞা মানতে হবে। সাধু পৌল বলেন, “যেহেতু আমরা তাঁর সহকর্মী, সেজন্য আমরা তোমাদের অনুরোধ করছি; তোমরা ঈশ্বরের অনুগ্রহ গ্রহণ করেছ, তোমাদের সেই গ্রহণটা যেন বৃথাই না হয়ে থাকে। কারণ তিনি একথা বলছেন, তোমাকে সাড়া দিয়েছি প্রসন্নতার সময়ে; তোমায় সহায়তা করেছি পরিত্রাণের দিনে।… এখন তো সেই প্রসন্নতার সময়, পরিত্রাণের সময়।” (২ করি ৬: ১-২) এই অনুগ্রহের সময় তাঁকে আমাদের পূজা ও সেবা করতে হবে যেন সেই অনুগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর তা না করলে আমাদের সেই অনুগ্রহ হারিয়ে যাবে।
ঘ) মানুষের অনুগ্রহে (আনুকুল্যে) বড় হওয়া
“কৃপা ও বিশ্বস্ততা তোমাকে কখনও ত্যাগ না করুক, এগুলো তোমার গলায় বেঁধে রাখ, তোমার হৃদয়-ফলকে লিখে রাখ। তবেই পরমেশ্বরের ও মানুষের দৃষ্টিতে তুমি অনুগ্রহ ও সাফল্য লাভ করবে।” (প্রবচন ৩: ৪) শুধুমাত্র খ্রিস্টান হওয়াই ঈশ্বরের ও মানুষের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা যদি ঈশ্বরকে ভালবাসি তা সহজেই মানুষের চোখে ধরা পড়বে।
যীশু যেভাবে বড় হয়েছেন, সেই ভাবেই প্রতিটি শিশুকে বড় হতে হবে। তিনি আমাদের আদর্শ ও বেড়ে ওঠার মাপকাঠি। তাঁর বেড়ে ওঠার কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শিশু হিসেবে তিনি তাঁর পিতামাতার প্রতি অনুগত ছিলেন (লুক ২: ৫১; ইফি ৬: ১; কলসীয় ৩: ২০)। খুব ছোট থেকেই তিনি তাঁর স্বর্গীয় পিতার বিষয়ে জানতেন। যেমন তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন (লুক ২: ৪৯); তাঁর জীবন স্বার্থপর ছিল না, তাঁর জীবন ছিল অন্যের জন্য (মার্ক ১০: ৪৫; ফিলি ২: ৪); তিনি জীবনে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন (যোহন ৬: ৩৮)। তাঁর আদর্শ সবার অনুকরণীয় (১ পিতর ২: ২১)।
শিশুদের প্রতি পিতামাতার কিছু করণীয় বিষয়:
১. শিশুদের এমনভাবে গঠন দান করা যেন তারা ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য বোঝার মত সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
২. পিতামাতার নিবিড়ভাবে দেখতে হবে যেন বয়সে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক শিশু ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে ওঠে, অর্থাৎ সমাজে সবার মধ্যে সুসম স্থান করে নেয়ার জন্য তাকে মৌলিক আচরণ ও দায়িত্ববোধ শিখতে হবে।
৩. ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাকে ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এতে সহায়ক হবে পবিত্র বাণী পাঠ, প্রার্থনা ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনী।
৪. মানুষের অনুগ্রহে বড় হবার জন্য একটি শিশুকে পিতামাতা, ভাইবোন ও গুরুজনদের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য শিখতে হবে।
আর্চবিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসি
চট্টগ্রামের আর্চবিশপ