বর্তমান ভাইরাস কোভিড- ১৯ (করোনা): ইতালির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে আমার ক্ষুদ্র ভাবনা

0
1122
লেখক: ফাদার রিগান ক্লেমেন্ট ডি’কস্তা
(উচ্চতর শিক্ষার জন্য বর্তমানে ইতালিতে অবস্থান করছেন)
ফাঃ রিগান ক্লেমেন্ট ডি’কস্তা
ফাঃ রিগান ক্লেমেন্ট ডি’কস্তা

প্রণাম মারীয়া প্রসাদে পূর্ণা, প্রভু তোমার সহায়; তুমি নারীকুলে ধন্যা, তোমার গর্ভফল যীশুও ধন্য। হে পুণ্যময়ী মারীয়া ঈশ্বর জননী, আমরা পাপী। এখন ও আমাদের মৃত্যুকালে আমাদের মঙ্গল প্রার্থনা কর। আমেন। শুরুতেই এ প্রার্থনাটি দেখে একটু অবাক হয়ে ভাবতে পারেন যে কেন আমি মা মারীয়ার সান্নিধ্য যাচ্না করে আমার ক্ষুদ্র চিন্তার প্রকাশ ঘটালাম! আর কেনইবা করবোনা? এইতো জানুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ করেই চীন থেকে করোনা বা কোভিড-১৯ এর করাল থাবা আছড়ে পড়ল পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ, অনাবিল সুন্দর দেশ, লাখো পর্যটকের পদাচরণে মুখরিত ইতালিতে।

মুহূর্তেই ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করলো লাখো পর্যটকের দেশ এই ইতালি; রাতারাতি পাল্টাতে শুরু করল সেই চিরচেনা দৃশ্যপটগুলো! অপার সৌন্দর্যে ঘেরা ভাতিকান সাধু পিতরের বাসিলিকার চত্ত্বর, কলোসিয়াম, পানির উপর ভেসে থাকা ভেনিস শহর, আগ্নেয়গিরি ও অগ্নুৎপাতের শহর পম্পেই, সুউচ্চ পিজা টাওয়ার, মায়াবি সৌন্দর্যময় কোমো লেক, হাজারো বড়- ছোট মনোমুগ্ধকর বাসিলিকা, মিলানের ডোমো প্রভৃতির সাক্ষ্য বহনকারী গোটা ইতালিই আজ যেন জনমানবশূণ্য হয়ে গেল, থেমে গেছে আনন্দের কোলাহল, পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করা হোটেল, বার, রেস্টুরেন্টগুলোও আজ বন্ধ হয়ে আছে। আর এসবই যেন কিসের অশনি সংকেত দিচ্ছে সারা বিশ্বকে; ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে নতুন করে!

কিন্তু আজও চির সবুজে ঘেরা সেই প্রকৃতি, অট্টালিকা, বাসিলিকা মানুষের আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে; দৃঢ় মনে প্রার্থনা করছে সবাই কবে ফিরে আসবে সেই স্বাভাবিক জীবন? তবে মজার বিষয় হল গোটা ইতালির মানুষ আজও ব্যস্ত, আজও তৎপর, আজও উৎসবমুখর; কিন্তু তাদের সময় কাটছে আর বাইরে গিয়ে নয়, বরং ঘরের ভিতরে থেকে প্রার্থনা, একসাথে খাওয়া-দাওয়া ও প্রিয়জনদের সময় দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইতালি কখনোই এমন ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়নি বা এরকমের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি

সামর্থ্যবানেরা দরিদ্রদের জন্য খাবার রেখে দিয়েছে

হয়নি। কিন্তু আজ এ মুহূর্তে ইতালি যেন এক ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এ যুদ্ধ কোন মারনাস্ত্র দিয়ে নয়, বরং অস্ত্রহীন থেকেই মানুষ বাঁচানোর লড়াই, মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে জীবন ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই। আর এ লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র ক্ষমতা, মোহ কিংবা দাম্ভিকতা নয়, বরং যার যার ঘরে থেকে একান্তে প্রার্থনা, শারিরীকভাবে নয় বরং আত্মিকভাবে সকলে এক হয়ে, সমালোচনা নয় বরং দেশের মঙ্গলের জন্যে যার যার অবস্থানে থেকে একযোগে কাজ করে এ মহামারী থেকে মুক্তি লাভ করা।

মানুষের এ বিনম্রতা, পাপময় জীবনের পরিবর্তন দেখে ঈশ্বর আবার হয়তো বিশ্ব তীর্থস্থান ইতালিতে ফিরিয়ে দেবেন লাখো মানুষের ঢল। বর্তমানে ধীরে হলেও এ অবস্থার পরিবর্তনও হচ্ছে। আর এ পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার হল বিশ্বাসপূর্ণ অন্তর নিয়ে একান্ত প্রার্থনা। তাই যেদিন থেকে এ মহামারী শুরু সেদিন থেকেই পোপ মহোদয় সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন আমরা যেন ব্যক্তিগতভাবে রোজারিমালা প্রার্থনা করি, মা মারীয়ার মধ্য

সাধু পিতরের বাসিলিকা হতে a blessing Urbi et Orbi

দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকি। তাই কাথলিক মণ্ডলীর কেন্দ্রস্থল ভাতিকানে এ মহামারীর শুরু হতে আজ অবধি বিশেষ রোজারিমালা প্রার্থনা করা হচ্ছে; পরিবারে পরিবারে ধ্বনিত হচ্ছে মা মারীয়ার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দয়া ও সান্নিধ্যলাভের অভিজ্ঞতা। আপনার, আমার ও সকলের বিশ্বাস- ঈশ্বর তাঁর অপরিসীম দয়া আবার আমাদের উপর ঢেলে দিবেন। আর ইতালির মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস তারা এ যুদ্ধে জয়ী হবেই, কারণ প্রেমময় ঈশ্বরের প্রতি মানুষ যে আস্থা রেখেছে!

এতক্ষণ তো আমার ব্যক্তিগত চিন্তার কিছু প্রকাশ ঘটালাম আর এখন জেনে নেই গোটা ইতালি বাস্তবিকভাবে কিভাবে এ মহামারীর সাথে লড়াই করছে এবং যা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও প্রথমত নিজেকে, অতঃপর আমাদের পরিবারকে, দেশকে তথা গোটা বিশ্বকে রক্ষা করতে পারি।

  • ইতালির সকল মানুষ ঘরকেই তাদের সবকিছু সম্পাদনের আপন ঠিকানা করে নিয়েছেন, নিজেকে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে রেখে পরস্পরের জন্য কিছু করার বা অন্যের জীবন রক্ষার জন্যেই এক অপার ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন; আর এর সুফল পেতে শুরু করেছে সকল মানুষ, ইতালিতে এখন ক্রমশ নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে চলেছে। এর মানে হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকর ক্ষুদ্র ত্যাগস্বীকারই গোটা দেশকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে।
  • ইতালিতে করোনা ভাইরাসের শুরু হতে যেটা লক্ষ্যনীয় বিষয় সেটা হল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে স্থানীয় সরকারের পদ্ধতিগত সমন্বয় ও একযোগে কাজ করার মানসিকতা। এখানে কেন্দ্র হতে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যথাযথ খাবার যোগান দেয়া, সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে যথাসময়ে সরঞ্জামাদি প্রদান করা, এসব বিষয়ে সকলইে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে।
  • ইতালি একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বাংলাদেশে যেমন অসংখ্য মসজিদ আছে, ঠিক একইভাবে ইতালিতে আছে অসংখ্য গির্জা ও বড় বড় বাসিলিকা। ভাইরাস পূর্ব সময়ে অসংখ্য মানুষ গির্জা ও বাসিলিকাগুলোতে প্রার্থনা ও উপাসনার জন্য জড়ো হতো, কিন্তু আজ দেশের মঙ্গলের জন্যে সবাই ঘরে থেকে প্রার্থনায় ঈশ্বরের অনুগ্রহ ভিক্ষা করছেন। আর এ সচেতনতাই ভাইরাসের বিস্তাররোধে অনেক সহায়ক  ‍ভূমিকা পালন করছে।
  • ইতালির ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিবেদিত ও প্রানপণ যুদ্ধ এ ভাইরাস হতে রোগীদের দ্রুত সুস্থ হতে
    নিবেদিতপ্রাণ একজন সেবিকা

    সাহায্য করছে। অনেক ডাক্তার, নার্স তাদের নিজেদের জীবনের বিনিময়েও মানুষ ও দেশের মঙ্গলের জন্য প্রানপণ লড়ে যাচ্ছে।

আজ সারা বিশ্ব একটি কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ব মহামারী বা দুর্যোগ বা কঠিন অবস্থা যাই বলিনা কেন, তা আমাদের নিজ নিজ জীবনের মূল্যকে আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা নিজেরাও এখন বুঝতে পারছি যে আমরা কি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি! তাই এই চরম সংকটময় মুহূর্তে আমাদের নিজেদেরকে বিবেক ও বোধকে জাগ্রত করা একান্ত দরকার, সচেতনতার বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। যারা আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ রয়েছি, আমাদেরকে এ ভাইরাসের বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে ও তাদেরকে যথাযথ দিক নির্দেশনা দিতে হবে। যেমনটি বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস তার পোপীয় পালকীয়কালের শুরু থেকে বলে এসেছেন: মণ্ডলীকে হতে হবে প্রেরণধর্মী, নজর দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর দিকে। এইতো, কয়েকদিন আগে অর্থাৎ পুনরুত্থান রবিবার তিনি বলেছেন, এই ভাইরাস বা মহামারী আমাদের

সাধু পিতরের বাসিলিকা সম্মুখে পবিত্র ক্রসের কাছে প্রার্থনা করছেন পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস

জন্য ব্যতিক্রম বা নতুন কিছু নয়, এটা জগতের শুরু হতে আজোবধি আছে এবং ভবিষ্যতেও তা মোকাবেলা করার জন্যে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে বর্তমানে জগতের প্রধান সমস্যা হল স্বার্থপরতা ও পারস্পরিক বিভেদ। এগুলো থেকে প্রত্যেকটি দেশকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এক হয়ে কাজ করতে হবে। ধনী দেশগুলো কর্তৃক তাদের সম্পদ বন্টনের সময় এসেছে; গরীব দেশগুলোর সাথে তাদের অবশ্যই সহভাগিতা করতে হবে। তা না হলে এ বিশ্ব দুর্যোগকে মোকাবেলা করা কঠিন ও অসাধ্য হয়ে পড়বে।

পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করছেন

বর্তমান বিশ্ব যে এক চরম দুঃসময় ও দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করা যায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে  পরিবর্তন দেখে। ঐতিহ্য অনুযায়ী রীতি আছে লাখো লাখো খ্রিস্টভক্তের উপস্থিতিতে পুণ্য ভূমি সাধু পিতরের বাসিলিকা হতে পুণ্য পিতা পোপ মহোদয় সারা পৃথিবীর জন্যে বিশেষ আশীর্বাদ (a blessing Urbi et Orbi) করেন। গত ২৭ মার্চ চিরচারিত ঐতিহ্য ধরে রেখে সারা পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় সে আশীর্বাদ প্রদান করা হয়েছিল; কিন্তু তা ছিল জনমানবশূণ্য বাসিলিকা থেকে। বেশ কিছুদিন যাবৎ প্রতি রবিবার জনমানবশূণ্য বাসিলিকা হতেই দূত সংবাদ প্রার্থনা ও আশীর্বাদ প্রদান করছেন পোপ মহোদয়। এমনকি এই বছর পূণ্য সপ্তাহের অনুষ্ঠান ও পুনরুত্থান উৎসবও ছিল জনমানবশূণ্য। ভাতিকানের এই পরিবেশই বলে দিচ্ছে সারা পৃথিবী কত বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থাই আজ বলে দিচ্ছে সারা পৃথিবী আজ অসুস্থ ও ভারাক্রান্ত। তাই সবাই চিরচেনা কোলাহল ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছে একাকী নির্জন ঘরে (isolation or quarantine)।

আজ সময় এসেছে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে গভীরভাবে এ মহামারীর ভয়াল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার। মহামারী নিরসনের জন্যে বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনার কোন বিকল্প নেই। তাই আমি লেখার শুরুতেই বলেছি যে, প্রার্থনা আমাদের ব্যক্তি জীবনে, আমাদের পরিবার জীবনে, আমাদের সমাজ জীবনে তথা গোটা বিশ্বকে এ ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের উচিৎ ভক্তিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনায় ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোঝা ও তার উপর নির্ভর করা। আর যে কাজটি যিনি কিনা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য তথা করোনা আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের সুস্থতা ও মঙ্গল কামনায় করে যাচ্ছেন; তিনি আর কেউই নন; আমাদের খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রধান ও আধ্যাত্মিক গুরু পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিস। পুণ্য পিতার বয়স ৮৪ বছর, একটি ফুসফুস নিয়ে তিনি বেঁচে আছে। দুবার পরীক্ষায়ও তাঁর শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তিনি সাধ্বী মার্থার চ্যাপেল বা প্রার্থনা গৃহ থেকে প্রতিদিন বিশেষ খ্রিস্টযাগ ও আরাধনা করে যাচ্ছেন। আসুন আমরাও নিজ নিজ গৃহকে ঈশ্বরের গৃহ বা প্রার্থনা গৃহে রূপান্তরিত করি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বাসপূূর্ণ অন্তর নিয়ে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ যাচ্না করি। আশা নয় বরং আমিও বিশ্বাস করি, আবার আমাদের এ পৃথিবী সেই আগের মত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে; আবারো আমরা মুক্ত অন্তরে পরম পিতার জয়গানে ছুটে বেড়াবো দেশ হতে দেশান্তরে।

তথ্য সূত্র ও সহায়িকা:

  • www.vaticannews.va
  • ইতালিয়ান দৈনিক সংবাদপত্র

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here