শ্রদ্ধেয় খ্রিস্টভক্তগণ,
প্রতি বছর এই সময় চল্লিশ দিন ব্যাপী আমরা তপস্যাকাল বা প্রায়শ্চিত্তকাল পালন করে থাকি। এই পবিত্র সময়টুকু সমগ্র মণ্ডলীর জন্য, স্থানীয় খ্রিস্টিয় সমাজের জন্য ও প্রতিজন খ্রিস্ট বিশ্বাসীর জন্য জীবন নবায়নের উপযুক্ত সময়কাল। সাধু পৌলের ভাষায় এই সময়টি ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের মুহূর্ত (দ্র: ২ করি ৬:২)। তপস্যাকালে আমরা স্মরণ করি আমাদের প্রত্যেকের প্রতি স্বর্গীয় পিতার অফুরন্ত ভালবাসা ও যত্নের কথা। “ঈশ্বর জগতকে এতই ভালবেসেছেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে দান করেছেন, তাঁর প্রতি যে কেউ বিশ্বাস রাখে, সে যেন বিনাশ না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পেতে পারে।”(যোহন ৩:১৬) “বন্ধুর জন্য প্রাণ দেওয়া: এর চেয়ে বড় ভালবাসা মানুষের আর কিছুই নেই।”(যোহন ১৫:১৩)
আমাদের পুণ্য পিতা পোপ ফ্রান্সিসের সাম্প্রতিক শিক্ষা থেকে তিনটি পরামর্শ আমাদের নবায়নের জন্য এই সময়ে গ্রহণ করতে পারি। তিনি পবিত্র বাইলের তিনটি কথা উল্লেখ করে জীবন নবায়নের জন্য আমাদের প্রতি আহ্বান রেখেছেন।
“একটা অঙ্গ ব্যথা পেলে সকল অঙ্গই তার সঙ্গে ব্যথা পায়, এবং একটি অঙ্গ সমাদর পেলে সকল অঙ্গই তার সঙ্গে আনন্দ করে।”(১ করি ১২:২৬)
খ্রিস্ট বিশ্বাসী আমরা খ্রিস্টের নিগূঢ় বা অতীন্দ্রিয় দেহ। যে কেউ খ্রিস্টের, সে তাঁর দেহের সঙ্গে যুক্ত। তাই আমরা একে অন্যের প্রতি উদাসীন থাকতে পারি না। দেহের অঙ্গ হিসেবে যদি একজন কষ্ট পায়, অঙ্গ হিসেবে সকলেই তার সঙ্গে কষ্ট পায়। যদি একটি অঙ্গ হিসেবে একজন সম্মান পায়, তখন অন্যান্যরা অঙ্গ হিসেবে সেই সম্মানের জন্য আনন্দ পায়। তাই খ্রিস্ট দেহ হিসাবে মণ্ডলীতে একে অপরের প্রতি উদাসীনতার কোন স্থান নেই। কারণ অন্য অঙ্গের প্রতি উদাসীনতা তো খ্রিস্ট দেহের প্রতিই উদাসীনতা। মানবিক দূর্বলতার কারণে আমরা কখনো কখনো অন্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি। ঈশ্বরের জন্য আমাদের ভালবাসা তখনই দূর্বল হয়ে যায়, যখন আমরা অন্যের প্রতি উদাসীন হই। যারা প্রকৃত খ্রিস্টভক্ত, ঈশ্বর তাদেরকে মঙ্গলময়তা ও করুণা পরিধান করতে সাহায্য করেন, যেন তারা যিশুর মত ঈশ্বরের ও সবার সেবক/সেবিকা হয়ে উঠতে পারেন। এই দৃশ্য আমাদের সামনে মূর্ত হয় পুণ্য বৃহস্পতিবার পা ধোওয়ার অনুষ্ঠানে। খ্রিস্ট মণ্ডলী হল পবিত্র মিলন সমাজ। এই মিলন সমাজে আত্মকেন্দ্রিকতার কোন স্থান নেই। এখানে কেউ একা সব কিছুর মালিক হয় না। বরং সে অন্যের সাথে তার সম্পদ ভাগকরে নেয়। সম্পদের সুসমবন্টন বা সহভাগিতা আমাদের নবায়নের একটি অপরিহার্য বিষয়।
ঈশ্বর কাইনকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার ভাই আবেল কোথায় ?”(আদি ৪:৯)
প্রায়শ্চিত্তকালে নিজেকে, আমাদের সমাজকে, আমাদের সংঘ-সমিতিকে, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন খ্রিস্ট দেহের অঙ্গ হিসাবে আমার বা আমাদের অভিজ্ঞতা কী ? দেহের একটি অঙ্গ হিসেবে আমি বা আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে যা পেয়েছি তা সহভাগিতা করছি কিনা? এক দেহ হিসেবে আমি বা আমরা দেহের দূর্বল, অভাবী, বা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গতুল্য ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দান করছি কিনা বা তার যত্ন নিচ্ছি কিনা। মঙ্গলসমাচারে বর্ণিত ধনী লোকটির প্রাসাদের প্রবেশ গেটে শুয়ে থাকা দরিদ্র ও অসুস্থ লাজারুসের জন্য আমার বা আমাদের হৃদয় দরজাও বন্ধ কিনা। প্রত্যেক খ্রিস্টিয় সমাজ বা সংঘ সমিতির প্রতি আহ্বান যেন তার নিজ স্বার্থের উপরে গিয়ে যারা অভাবী ও দরিদ্র, বা যারা খ্রিস্টিয় মূল্যবোধ থেকে দূরে চলে গিয়েছে তাদের কাছে যাওয়া ও তাদেরকে কাছে টেনে নেয়া।
প্রকৃতিগত ভাবে খ্রিস্ট ম-লী প্রেরণমুখী। খ্রিস্ট মণ্ডলী গণ্ডিবদ্ধ নয়,বরং সর্বত্র ও সব জাতির কাছে প্রেরিত। মণ্ডলীর প্রৈরিতিক দায়িত্ব সবাইকে স্বর্গস্থ পিতার ভালবাসার আশ্রয়ে নিয়ে আসা। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “আমার কতই না ইচ্ছা, যেখানে মণ্ডলী উপস্থিত, বিশেষতঃ আমাদের ধর্মপল্লী ও আমাদের খ্রিস্ট সমাজ – সেগুলো যেন উদাসীনতার সাগরে দয়া ও ভালবাসার দ্বীপ হয়ে ওঠে।”
“তোমরা ধৈর্যশীল হও, অন্তর সুস্থির কর..,” (যাকোব ৫:৮)
উদাসীনতা বর্তমানে একটি বড় প্রলোভন। বর্তমানে মানুষের দুঃখ-কষ্টের বিভিন্ন ধরণের সংবাদ আমাদের বিচলিত করে। আর সেই ক্ষেত্রে কোন সাহায্য করতে আমরা অপারগতা অনুভব করি। আবার সমাজের বিভিন্ন সত্য-অসত্য সংবাদে আমরা বিভ্রান্ত হই। এই অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? প্রথমতঃ আমরা জগতের তীর্থযাত্রী মণ্ডলীর ও স্বর্গের বিজয়ী মণ্ডলীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রার্থনা করতে পারি। এক কন্ঠে প্রার্থনা করার শক্তি আমরা যেন কম গুরুত্ব না দেই। দ্বিতীয়তঃ প্রতিদিনই কিছ কিছু দয়ার কাজ করি, যারা কাছে তাদের জন্য, আবার যারা দূরে তাদের জন্যেও। মণ্ডলীর রয়েছে বিভিন্ন দয়ার কাজের সংগঠন, যার মধ্য দিয়েও আমরা দয়ার কাজ করতে পারি অপেক্ষাকৃত বেশী অভাবী ও দুঃখী ভাই-বোনদের জন্য। প্রায়শ্চিত্তকাল একটি উপযুক্ত সময় যখন আমরা ক্ষুদ্রভাবে হলেও অন্যের প্রতি মনযোগী হতে পারি,কারণ আমরা সবাই একই মানব পরিবারের সন্তান। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, দয়ালু চিত্ত মানে নয় দূর্বল চিত্ত। যে দয়ালু হতে চায়, তার থাকতে হবে দৃঢ় ও একনিষ্ঠ চিত্ত; আত্মসুখ সন্ধানী না হয়ে সহমর্মী হওয়ার দৃঢ় মনোভাব। এইভাবে আমাদের চিত্ত হবে দৃঢ় ও দয়ালু, মনযোগী ও উদার। যে চিত্ত স্বার্থপর বা অন্যের জন্য বদ্ধ, তা উদাসীনতার শিকার হতে পারে।
আমাদের এই চল্লিশ দিনের সংগ্রাম হলো আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতার বন্য জন্তুটির সঙ্গে, যা আমাদের অন্তরে ও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যিশু বলেন স্বর্গরাজ্য আসন্ন। কৃত অপরাধের জন্য অনুতাপ কর ও মঙ্গলসমাচারে বিশ্বাস কর।
অনুধ্যান ও প্রার্থনার জন্য সহায়ক প্রশ্ন: (ক) খ্রিস্টের নিগূঢ় দেহ বা খ্রিস্টিয় সমাজের অঙ্গতূল্য যে ব্যক্তিগুলোর ব্যথা বা কষ্ট রয়েছে, তা আমি কতটুকু জানি ও অনুভব করি? … তাদের জন্য আমি কি করতে পারি? (খ) আমার ভাই বা বোন কোথায়? … আমার বাবা বা মা কোথায়? … আমার ছেলে বা মেয়ে কোথায়? … আমার প্রতিবেশী কোথায়? … তাদের প্রতি আমি কতটুকু যত্নশীল? (গ) সমাজের নেতিবাচক অবস্থার সামনে আমার চিত্ত কতটুকু দৃঢ় বা উদার?
আমাদের আর্চডাইয়োসিসের ‘প্রেরণ বর্ষ ২০১৮’-তে সবার জীবনে এই তপস্যাকালটি ঈশ্বরের প্রচুর কৃপা নিয়ে আসুক।
সকলের মঙ্গল কামনায়,
আর্চবিশপ মজেস কস্তা, সি.এস.সি.
চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস